বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা বর্তমান বিশ্বের একটি অত্যাধুনিক ও কার্যকর নিরাপত্তা পদ্ধতি। ডিজিটাল যুগে তথ্য ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। তাই সকলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এই বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা পদ্ধতি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হবে। বায়েলজিক্যাল ডাটা এ্যানালাইসিস করে প্রতিটি মানুষকে ইউনিক ভাবে সনাক্ত করার দক্ষতা রয়েছে এই বায়োমেট্রিকের।
Biometrics নিরাপত্তা কী?
Biometrics Data হল মানুষের শরীরের এমন এক অনন্য শারীরিক বা আচরণগত বৈশিষ্ট্য, যা কোন ব্যক্তিকে নির্দিষ্টভাবে শনাক্তকরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। সাধারণত বায়োমেট্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফেসিয়াল রিকগনিশন, আইরিস স্ক্যানিং, ভয়েস রিকগনিশন এবং হাতের রেকগনিশন। এই বৈশিষ্ট্যগুলো একে অপরের থেকে অনন্য এবং পরিবর্তন করা অসম্ভব। যার ফলে এগুলো নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি। এগুলোর মাধ্যমে আমরা এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিকে আলাদা করতে পারি। পৃথিবীতে যত মানুষ রয়েছে সবাইকে আলাদা ভাবে সনাক্ত করতে পারে এই বায়োমেট্রিক। তাই নিরাপত্তায় বায়োমেট্রিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বায়োমেট্রিক এর ইতিহাস
আঙ্গুলের ছাপের একটি প্রাথমিক তালিকা 1885 সালের দিকে যখন জুয়ান ভুসেটিচ আর্জেন্টিনায় অপরাধীদের আঙ্গুলের ছাপের সংগ্রহ শুরু করেছিলেন। জোশ এলেনবোগেন এবং নিতজান লেবোভিচ যুক্তি দিয়েছিলেন যে বায়োমেট্রিক্সের উদ্ভব হয়েছে অপরাধমূলক কার্যকলাপের শনাক্তকরণ পদ্ধতিতে। যা আলফোনস বার্টিলন (1853-1914) এবং ফ্রান্সিস গ্যাল্টনের আঙ্গুলের ছাপ এবং শারীরবৃত্তীয় তত্ত্ব দ্বারা তৈরি।
Read Also : IPL Winners List from 2008 to 2024: KKR Won IPL Final
তদনুসারে, “বায়োমেট্রিক সিস্টেম আমাদের যুগের নিখুঁত রাজনৈতিক অস্ত্র” এবং “নরম নিয়ন্ত্রণ” এর একটি রূপ। তাত্ত্বিক ডেভিড লিয়ন দেখিয়েছেন যে, বিগত দুই দশকে বায়োমেট্রিক সিস্টেমগুলি বেসামরিক বাজারে প্রবেশ করেছে এবং সরকারী নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যক্তিগত কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের মধ্যে লাইনগুলিকে অস্পষ্ট করে দিয়েছে। কেলি এ. গেটস 9/11 কে আমাদের বর্তমানের সাংস্কৃতিক ভাষার জন্য টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
বায়োমেট্রিক পদ্ধতির ধরন
১. ফিঙ্গারপ্রিন্ট শনাক্তকরণ: এক ব্যক্তির আঙ্গুলের ছাপের সাথে অন্য ব্যক্তির আঙ্গুলের ছাপের কিছুটা হলেও পার্থক্য থাকে। বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে এই পার্থক্য শনাক্ত করা যায়। কারণ কারো আঙ্গুলের ছাপের সাথে আর কোনো মানুষের আঙ্গুলের ছাপ মিলবে না।
২. ফেসিয়াল রিকগনিশন: প্রতিটি ব্যক্তির মুখের অবয়ব ও বৈশিষ্ট্য অন্য আরেক ব্যক্তির থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে আমরা সহজেই এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিকে পৃথক করতে পারি। যেমন আমরা আমাদের স্মার্টফোনে ফেস লক করি। যা নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া আন লক করা অসম্ভব।
৩. আইরিস স্ক্যানিং: প্রতিটি ব্যক্তির চোখের আইরিশের পার্থক্য থাকে। প্রতিটি মানুষের ইউনিক আইরিশ। আমরা বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে এর পার্থক্য নির্ণয় করতে পারি। যা এক ব্যক্তিকে অন্য ব্যক্তি থেকে খুব সহজেই আলাদা করতে পারে।
৪. ভয়েস রিকগনিশন: একজন মানুষের সাথে অপর মানুষের ব্যক্তির কণ্ঠ স্বরে পার্থক্য থাকে। আমাদের কন্ঠের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একজন মানুষ যেভাবে কথা বলে অন্য আরেকজন মানুষ সেভাবে বলতে পারেনা। অনেকর কন্ঠস্বর একই শোনা গেলেও পার্থক্য রয়েছে। যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে আলাদা ভাবে নির্বাচন করা যায়।
৫. হাতের রেকগনিশন: মানুষের হাতের প্যাটার্ন ও আকৃতির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এর মাধ্যমে যেকোন ব্যক্তিকে হাতের প্যাটার্ন দিয়ে সনাক্ত করতে পারি।
এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি রয়েছে। যেমন: ডিএনএ, রেটিনা স্ক্যান প্রভৃতি।
বায়োমেট্রিক নিরাপত্তার কার্যপ্রণালী
বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা পদ্ধতি কার্যকর হওয়ার পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধাপ রয়েছে। যেমন:
১. ডেটা সংগ্রহ: প্রথমেই আমাদের নির্দিষ্ট বায়োমেট্রিক ডেটা সংগ্রহ করতে হয়। যেমন ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফেসিয়াল ইমেজ প্রভৃতি।
২. ডেটা স্টোরেজ ও এনক্রিপশন: অতঃপর সেই সংগৃহীত ডেটা এনক্রিপ্ট করে নিরাপদ ডাটাবেসে সংরক্ষণ করতে হয়।
৩. মিলানোর প্রক্রিয়া: নির্দিষ্ট সময়ে, সংগৃহীত ডেটার সাথে লাইভ ডেটা মিলিয়ে দেখার মাধ্যমে সেই ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে হয়।
বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা এর সুবিধা
বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা পদ্ধতির বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সুবিধা রয়েছে:
১. উচ্চতর সুরক্ষা: বায়োমেট্রিক ডেটা নকল করা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ, যা এই বায়োমেট্রিক পদ্ধতির নিরাপত্তা বহুগুন বৃদ্ধি করে।
২. ব্যবহারকারীর সুবিধা: নিরাপত্তার জন্য পাসওয়ার্ড বা পিন ব্যবহার করি, যা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু বায়োমেট্রিক পদ্ধতির ক্ষেত্রে পাসওয়ার্ড বা পিন মনে রাখার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র বায়োমেট্রিক বৈশিষ্ট্যই যথেষ্ট। যার মাধ্যমে পিন বা পাসওয়ার্ড এর মতো স্থানে ফিঙ্গার, হাত, চোখ ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারি।
৩. চুরি ও জালিয়াতির প্রতিরোধ: অন্য সকল নিরাপত্তা থেকে অনেক বেশি ইউনিক হওয়ার ফলে বা বায়োমেট্রিকের বৈশিষ্ট্যের কারণে বায়োমেট্রিক ডেটা চুরি বা জাল করা কঠিন। কেউ চাইলেই এই পদ্ধতি ভেদ করে চুরি করতে পারবে না। অথবা নিজেকে অপরাধী থেকেও লুকাতে পারবে না।
বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ
বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা পদ্ধতির বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন :
১. গোপনীয়তা এবং নৈতিকতা: বায়োমেট্রিক ডেটা সংরক্ষণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয়। কিন্তু অনেক সময় নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে তা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। নৈতিকতা ঠিক না থাকলে নিরাপত্তা জনিত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
২. প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা: অনেক সময় প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে সঠিক বিষয়টি শনাক্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। বায়োমেট্রিক যেহেতু একটি ডিজিটাল প্রযুক্তি তাই বিভিন্ন সময় প্রযুক্তিগত যেকোনো ত্রুটি হতে পারে। অন্যথায় এটি সঠিক তথ্য প্রদান করবে।
৩. ভুল শনাক্তকরণ: প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে ভুল কিছু শনাক্তকরণ হতে পারে। ধরুন কোনো একজন ব্যক্তির সাথে অপর একজন ব্যক্তির তথ্য মিলে গেলো কিংবা কোনো মিস ইনফরমেশন দিলো, যা প্রযুক্তিগত ভুল হতে পারে।
ব্যবহার ক্ষেত্র
বর্তমানে বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা পদ্ধতির বিস্তর প্রয়োগ রয়েছে। যেমন :
১. ব্যক্তিগত ডিভাইস: বর্তমানে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ প্রভৃতি আধুনিক যন্ত্রপাতিতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফেস রিকগনিশন প্রভৃতি বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। যার মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা দেয়া সম্ভব।
২. স্বাস্থ্যসেবা: বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে বর্তমানে প্রতিটি রোগের তথ্য আলাদা আলাদা ভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। চিকিৎসা সেবায় অনন্য অবদান রাখছে এই বায়োমেট্রিক পদ্ধতি।
৩. ব্যাংকিং ও অর্থনীতি: লেনদেন ও অ্যাকাউন্ট সুরক্ষায় বায়োমেট্রিক পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এর ফলে এক ব্যক্তির একাউন্ট থেকে অপর ব্যক্তি কোন ভাবেই জালিয়াতি করে টাকা উত্তোলন করতে পারছে না। কারণ একজন ব্যক্তির ব্যাংক তথ্য নেয়ার আগে উক্ত ব্যক্তিকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি উক্ত এ্যাকাউন্টের মালিক।
৪. পাবলিক নিরাপত্তা: নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রমে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির ব্যবহার অপরিসীম। এছাড়াও বিমানবন্দর, অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি স্থানে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের উপস্থিতি কিংবা শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভবিষ্যতের দৃষ্টিকোণ
বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা পদ্ধতি ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে এই পদ্ধতি আরও উন্নত ও নির্ভরযোগ্য রুপ নিচ্ছে। যেমন, বায়োমেট্রিক সেন্সর ও এলগরিদমের উন্নয়ন, দ্রুত ডেটা প্রক্রিয়াকরণ এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভবিষ্যতে এটি আরও কার্যকর ও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। যেখানে নিরাপত্তা জনিত সমস্যা মানুষের অনেক তথ্য, অর্থ হারিয়ে যাচ্ছে কিংবা চুরি হচ্ছে সেখানে এই পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়া কোনো অপরাধীকে সনাক্তকরণে নির্দিষ্টভাবে খূঁজে বের করা যায়। বায়োমেট্রিক বর্তমানে ব্যাপক পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে।
বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি অত্যন্ত কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে এর ব্যবহারে আরও নতুন নতুন সম্ভাবনা দেখা দেবে। তবে গোপনীয়তা ও নৈতিকতার দিকগুলো বিবেচনা করে এটি ব্যবহার করা উচিত। আশা করি আজকের বায়োমেট্রিক নিয়ে লিখা আর্টিকেলটি আপনাদের ভালো লেগেছে। পরবর্তী আর্টিকেলে জন্য আমাদের সাথে থাকুন।
[…] বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা: পরবর্তী প্রজন… […]
[…] আরো পড়ুনঃ বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা: পরবর্তী প্রজন… […]